ফেসবুক ওরিয়েন্টেশন

ফেসবুক ওরিয়েন্টেশনঃ যা করবো আর যা ছাড়বো!

কিছুদিন আগে ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি পাবার লাইভ ভিডিওটি দেখছিলাম। চমৎকার সব কমেন্ট সেখানে, জাকারবার্গ সাহেবকে অভিনন্দন জানানো থেকে শুরু করে সে নিয়ে ব্যক্তিগত জীবনের নানা অভিজ্ঞতায় ভরা সেসব কমেন্ট। পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকেও কিছু কমেন্ট দেখলাম। কয়েকটিতে চোখ আটকে গেল। একজন লিখেছেন, “নোয়াখালি বিভাগ চাই!” আরেকজনের সরস কমেন্ট- “এ কেমন বিচার?” অনেকে আবার অবাক করে চিকন পিনের চার্জার চেয়েই যাচ্ছে।
একটা কথা মাথায় এলো এসব দেখে। এই যে মার্ক জাকারবার্গের ভিডিওতে এমন অপ্রয়োজনীয় আর অপ্রাসঙ্গিক কমেন্ট করেছেন অনেকেই, ব্যাপারটা কিন্তু নেহাতই রসিকতার পর্যায়ে থাকে না।
আমাদের এরকম কমেন্ট, এগুলো কিন্তু শুধু একজন মানুষকে রিপ্রেজেন্ট করে না। এগুলো একটা দেশকেও রিপ্রেজেন্ট করে। এসব দেখে বিদেশের মানুষেরা মনে করতেই পারে, বাঙ্গালিরা হচ্ছে বোকা, তারা জানেও না কোথায় কি কমেন্ট করতে হয়! একবার ভেবে দেখুন তো ব্যাপারটা আমাদের দেশের জন্য কি সাংঘাতিক অপমানজনক?



চিন্তা করে দেখলাম, সবাইকে দোষ দিয়েই বা কি লাভ। আমরা স্কুল কলেজে যখন পড়েছি, তখন সেখানে প্রথম বছরেই একটা ওরিয়েন্টেশন হতো। কি কি করতে হবে, কি করা যাবে না- এসব নিয়ে বিশদ জানানো হতো আমাদের। বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি ছুঁয়ে কিন্তু প্রথম বর্ষেই আমরা আরেকটা ওরিয়েন্টেশন পেয়েছি, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলোর জন্যে দিকনির্দেশনা ছিল। এই ভার্চুয়াল যে জগতে আমাদের নিত্য আনাগোনা দেখা যাচ্ছে, এখানে আসার আগে কিন্তু আমরা কোন ওরিয়েন্টেশন পাই নি। আর সেজন্যেই এমন হাল হয়েছে অনেকেরই।
ভাবতে ভাবতেই মাথায় আসলো, এই যে আমাদের ভার্চুয়াল জগত, এটা নিয়ে আমি নিজেই একটা ডিজিটাল ওরিয়েন্টেশন নিয়ে ফেলি না কেন!
ফেসবুককে কিন্তু আমাদের ডিজিটাল প্রোফাইল বলা যেতে পারে। আপনার বাস্তব জীবনের চেনা মানুষগুলোর থেকে এই ভার্চুয়াল জগতের চেনা মানুষের সংখ্যা কিন্তু বেশি। তাই আপনার ডিজিটাল ওরিয়েন্টেশন হবে ফেসবুক প্রোফাইল আর তার ব্যবহারগুলো নিয়েই! ফেসবুককে সঠিকভাবে ব্যবহার করার সবচে দরকারি ব্যাপারগুলো নিয়ে বলা যাক তাহলে!
১। ফেসবুক আইডি:
আমরা আমাদের পরীক্ষার সার্টিফিকেটে আমাদের পুরো নামটাই দেই, তাই না? ফেসবুককে যেহেতু আমাদের ভার্চুয়াল প্রোফাইল বলা হচ্ছে, তাই ফেসবুকেও আপনার পুরো নামটা দেয়া উচিত। আপনার নাম নেহাতই যদি অদ্ভুত বালক, এঞ্জেল কণা বা ড্রিম বয় রিফাত না হয়ে থাকে, তাহলে সেগুলো বাদ দিয়েই আপনার ফেসবুক আইডির নাম দিতে হবে আসল নাম দিয়ে। নইলে কোন একদিন ফেসবুক সিদ্ধ্বান্ত নেবে, এমন নামের কারো থাকার সম্ভাবনা নেই, তাই গায়েব হয়ে যাবে আপনার ফেসবুক প্রোফাইল।
২। প্রোফাইল পিকচার আর কাভার ফটো: 
আপনি যদি আপনার প্রোফাইল পিকচারে সালমান খান বা একটা গোলাপ ফুলের ছবি দেন, তখন মানুষ স্বভাবতই মনে করবে যে আপনি তো সালমান খান নন, আর গোলাপ ফুল তো আর ফেসবুক আইডি খুলতে পারে না, তাই আপনার নিশ্চয়ই কোন কুমতলব আছে! এরকম অহেতুক সন্দেহ থেকে বাঁচতে নিজের প্রোফাইল পিকচারে আর কভার ফটোতে নিজেরই একটা ছবি দিয়ে ফেলুন, যদি অন্য কোন সমস্যা না থেকে থাকে।
৩। ফেসবুক পোস্টঃ
ফেসবুকের নিউজ ফিডকে বলা যায় ভার্চুয়াল জগতের চৌরাস্তা। আপনি কি চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে ইচ্ছেমতো যা মন চায় উল্টোপাল্টা সব বলতে পারবেন? পারবেন না। সেজন্যে ফেসবুকে কোন পোস্ট করার আগে একটু ভেবে নেবেন, চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে কি এরকম কোন কাজ করতে পারতেন? না পারলে দয়া করে এমন কোন পোস্ট করবেন না যেগুলোর জন্যে আপনার তো বটেই, আপনার ফেসবুক বন্ধুদেরও মানসম্মান নিয়ে টানাটানি পড়ে যায়! 
ধরুন বাইরে অনেক রোদ। এখন আপনি যদি ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন যে বাইরে তীব্র রোদ, Feeling ঘাম ঘাম, তাহলে কিন্তু বাকিরা আপনাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে। আপনার কোন কথাকেই তারা আর গুরুত্বের সাথে নেবে না। তাই ফেসবুকে কিছু পোস্ট করার আগে একটু ভেবে নিলেই দেখবেন আর কোন সমস্যা হবে না!
৪। কমেন্টঃ
এটাকে বলা যায় সবচে দরকারি লেসন। আমরা ছোটবেলা বাবা-মার কাছ থেকে সবাই এই শিক্ষাটা পেয়েছি, যে অপরিচিত মানুষের সাথে ভালো ব্যবহার করতে হয়, আদব লেহাজের সাথে চলতে হয় সবার সাথেই। বাস্তব জগতের এই ভদ্রতাটা কিন্তু ভার্চুয়াল জগতের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
কেউ একজন কিছু একটা পোস্ট করলো, তাতে আক্রমণাত্মক কমেন্ট, গালাগালি করা কিংবা হুমকি দেয়া কিন্তু একেবারেই ঠিক না! আপনি হয়তো ভাবছেন এ তো সামান্য ফেসবুক, এখানে একটু ঝগড়াঝাঁটি করলে এমন আর কি হবে। কিন্তু এটা ফেসবুক বলেই আপনাকে খুব সহজে ট্র্যাক করা যাবে, ধরে ফেলা যাবে। তাই কমেন্ট করার সময় একটু ভেবেচিন্তে করলেই দেখবেন আপনার ভার্চুয়াল লাইফ কত সুন্দর হয়ে গিয়েছে!
এ তো গেল ফেসবুকের সাধারণ কার্যকলাপ। এসব বাদেও, শুধুমাত্র ফেসবুক ব্যবহার করে কিন্তু দারুণ কিছু করে ফেলা যায়, ছোটখাট বিপ্লব এনে দেয়া যায়। ফেসবুকের সদ্ব্যবহার করার এমন কয়েকটি আইডিয়াও বলে দিচ্ছি এখানে:
১। আর নয় রক্ত নিয়ে দুশ্চিন্তা!
এই আইডিয়াটা ব্লাড গ্রুপ নিয়ে। আমাদের আশেপাশে এমন অনেক অর্গানাইজেশন আছে যারা এই রক্ত সংগ্রহের জন্যে, মুমূর্ষু রোগীদের একটুখানি বাঁচার সুযোগ করে দেবার জন্যে দিন রাত খেটে চলেছে। এমনই একটা অর্গানাইজেশনের একজন আমাকে একটা আইডিয়া দেয়। খুব সহজ কিন্তু দারুণ কার্যকরী একটা আইডিয়া।
আমাদের সবারই কিন্তু একটা সোশ্যাল আইডি কার্ড আছে। তার নাম ফেসবুক। এই ফেসবুকের প্রোফাইলে ছোট্ট একটা BIO অংশ আছে। এইখানে আমরা নিজের পরিচয় দেবার পাশাপাশি যদি নিজের ব্লাড গ্রুপটাও দিয়ে দেই, তাহলে এই রক্ত সন্ধানীদের জন্যে অনেক সুবিধা হয়ে যায়, তাই না? এতে আরো দ্রুত রক্ত সংগ্রহ করা যাবে, হয়তো বাঁচানো সম্ভব হবে আরো কিছু প্রাণ!
২। ফেসবুকেই হোক গ্রুপ স্টাডি!
বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের প্রায় সব ব্যাচেরই নিজেদের জন্যে একটা ফেসবুক গ্রুপ আছে। সেখানে তারা ডিপার্টমেন্টের নানা খবর, নোটিশ নিয়ে পোস্ট করে। এই গ্রুপগুলোতে যদি ভালো ছাত্রদের মধ্যে কেউ উদ্যোগ নিয়ে পরীক্ষার আগে লাইভে যায়, আর পড়া বিষয়ক নানা সমস্যার সমাধান করে দেয়, দারুণ হয় না ব্যাপারটা?
এতে করে যে বন্ধুটা পড়াশোনায় দুর্বল তার যেমন উপকার হবে, তেমনি ভালো ছাত্রদেরও ঝালাই করে নেয়া হবে তাদের পড়াগুলো!
৩। এক শেয়ারে হবে স্বপ্নপূরণ!
এই আইডিয়াটা আমি পাই একটা ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে। আমার খুব প্রিয় একজন মানুষ, আরিফ আর হোসাইন এর একটা স্ট্যাটাস থেকে।
একটা স্কুল বানানো হচ্ছিল। কিন্তু অর্থের অভাবে কাজটা আর এগোচ্ছিল না। আরিফ ভাইয়া করলেন কী, তিনি একটা স্ট্যাটাস দিলেন। খুব সহজ কাজ। স্কুলটার জন্যে সবাইকে বললেন একটা করে শেয়ার কিনতে। ৩০০ টাকার একটা শেয়ার। কিছুদিনের মধ্যেই প্রচুর মানুষ এই শেয়ার কিনে জোগাড় করে ফেললেন স্কুলের টাকাটা! 
একবার ভাবুন তো? আপনার শেয়ারের কারণে কত শিশুর মুখে হাসি ফুটছে? মনটাই ভালো হয়ে যায় না ভাবলে? এইভাবে একটা শেয়ার কেনার মাধ্যমে বিশাল একটা ভালো কাজের অংশ হয়ে গেলেন আপনিও! আর ফেসবুককে কাজে লাগিয়ে এখানেও ঘটে গেল ছোটখাট একটা বিপ্লব!
আমি জানি যারা এই লেখাটা পড়ছেন তারা সবাই ফেসবুকের এসব বিষয় নিয়ে যথেষ্ট সচেতন। তাই আমি আশা করবো আশেপাশের মানুষগুলোকেও শেখাবেন ফেসবুকের এই ব্যবহারগুলো! তাতে যেটা হবে, সারা বাংলাদেশ একসময় ঠিকভাবে ফেসবুক ব্যবহার করা শিখবে। আমাদের একটা সুন্দর ভার্চুয়াল লাইফ হবে। হয়তো মার্ক জাকারবার্গের পরের লাইভ ভিডিওতে চিকন পিনের চার্জার বা নোয়াখালি বিভাগ নিয়ে নয়, সায়েন্টিফিক দুর্দান্ত কোন প্রশ্ন করবে বাঙ্গালিরা, দারুণ কোন কমেন্ট করে তাক লাগিয়ে দেবে। আর বিশ্ব অবাক তাকিয়ে বলবে, “শাবাশ, বাংলাদেশ!”
-Collected

Comments

Popular posts from this blog

Link3 FTP Server

কেন গবেষণা করব?

Arduino Adventures by Floyd Kelly James and Harold Timmis