কেন গবেষণা করব?

এই রচনাটার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে গরু খুঁজতে উৎসাহিত করা।
এখন যদি আপনি বলেন, ভাই আমার তো গরু নাই, তাহলে গরু খুঁজবো কেমন করে, তাহলে আমি বলবো যে অবশ্যই আপনার গরু আছে-কিন্তু আপনি জানেন না যে আপনার গরুটা আসলে আপনার গরু। কারণ আপনি কোনদিন আপনার গরুটাকে খুঁজেনই নাই, মহাজনের স্বাস্থ্যবান গরু দেখে মনে করেছেন যে আপনার গরু খোঁজার যোগ্যতা নাই। হয়তো আপনি অন্য কারো গরুকে নিজের ভেবে পেলেপুষে বড় করছেন-অথচ জানেনও না যে কেনো করছেন। অথবা আপনি হয়তো ভেড়া হয়ে গেছেন, আপনার মগজে সাদা সাদা পশম গজিয়েছে এবং আপনি সবাই যেদিকে যাচ্ছে, সেদিকেই যাচ্ছেন-কিন্তু কোথায় যে যাচ্ছেন-ঠিক জানেন না। অথচ আপনি কিন্তু গরু খুঁজতে পারতেন, খুজে পেলে সেই গরু দুধ দিতো, মাংস দিতো, হালচাষে সাহায্য করতো আর হাগুও করতো যা দিয়ে আপনি আর আপনার আশেপাশের সবাই উপকৃত হত।
আপনি অবশ্য এতোক্ষণে টের পেয়ে গেছেন যে এই গরু সেই গরু না-আর এই ভেড়া সেই ভেড়া না। এই বইয়ের গরু খোঁজা মানে হচ্ছে গবেষণা। গবেষণা (গো+এষণা) শব্দটার বুৎপত্তিগত (etymological) অর্থ হলো গরু খোঁজা। মনে করে দেখেন-এসএসসির বাংলা ব্যকরণের বইতে লেখা থাকে যে গবেষণা একটা রুঢ়ি শব্দ কারণ এই শব্দটা এখন আর বুৎপত্তিগত অর্থে ব্যবহৃত হয়না।



কিন্তু আমার মনে হয় এই উৎসটার তাৎপর্যটা ঠিক ততটা নিছক নয়। যারা এই শব্দটার জন্ম দিয়েছিলো অর্থাৎ প্রাচীন ভারতীয়রা-তাদের কাছে গরু খোঁজার তাৎপর্যটা কিন্তু অনেক বেশিই ছিলো। গরু ছিলো তাদের জীবনযাপনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ-তাদের বেচে থাকবার এবং উন্নতি করবার সবচেয়ে বড় মাধ্যম আর সামাজিক প্রতিপত্তির একটা পরিচায়ক। এই গরু এতো গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে চলে গিয়েছিলো যে তারা গরুর উপরে রীতিমতো দৈবিক গুরুত্ব আরোপ করেছিলো। কাজেই কারো গরু হারিয়ে যাওয়া মানে তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ হারিয়ে যাওয়া আর হারিয়ে যাওয়া গরু খোঁজা মানে জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ খুঁজে বের করার খুব একটা কম নয়।
কাজেই আমাদের কাছে গরু খোঁজা জিনিসটাকে যতোটা হাস্যকর মনে হচ্ছে-তাদের কাছে কিন্তু ততটা হাস্যকর ছিলোনা। এইযে পরিবর্তিত সময়ে, পরিবর্তিত বাস্তবতায় পরিবর্তিত রসবোধ সৃষ্টি হয়ে, এটা কিন্তু গবেষণা শব্দটার বুৎপত্তিগত অর্থের দ্বিতীয় ব্যখ্যাকে সমর্থন করে-যেটা বলছে যে গো+এষণার গো অংশটির মানে সরাসরি গরু নয়-বরং গতিশীল কোনকিছু। গো শব্দ থেকে গতি আর গো এর ইংরেজি ভার্সন হলো go, অর্থাৎ গো কে অন্বেষণ করা মানে যা কিছু গতিশীল তার খোজ করা। কি গতিশীল? গরু গতিশীল-এবং একটু আগের উদাহরণটা থেকে আমরা টের পেলাম যে গরুর গুরুত্বও গতিশীল। যা কিছু পরিবর্তিত হয়-কিছুক্ষ পর পর সেটা আবার খোঁজা প্রয়োজন হয়-যেকারণে গবেষণার ইংরেজি পরিভাষা হলো research.
এখন কোন জিনিসটা পরিবর্তনশীল? যদি উচ্চস্তরের দার্শনিক কোন একজন বৃদ্ধ ব্যক্তির কাছে যান সে আপনাকে সাথেসাথেই বলে দেবে যে দুনিয়া আর আগের মতন নাইরে বাজান। আমি যখন জোয়ান ছিলাম তখন মানুষের বুক ছিলো সাগরের সমান, কেউ এতো স্বার্থপর আছিলো না, আকাশে হাতি উড়তো...ইত্যাদি, ইত্যাদি। আর যদি আরও একটু পুরোনো আমলের লোকজনের সাথে কথা বলতে চান-তাহলে গ্রীক দার্শনিক হেরাক্লিটাস সাহেবের সাথে কথা বলা যাক। তিনি আপনাকে বলে দেবেন যে এক নদীতে দুইবার পা রাখা যায়না, কারণ আপনি যতক্ষনে দ্বিতীয়বার পা রাখবেন, ততক্ষণে হয় নদীটি কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছে (স্রোত বয়ে গেছে, পানির তাপমাত্রা পরিবর্তিত হয়ে গেছে ইত্যাদি) অথবা আপনি কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছেন (আপনার নখ কিছুটা লম্বা হয়েছে, আপনার মন কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছে)।
তবে আরেক জনপ্রিয় গ্রীক দার্শনিক প্লেটোর অবশ্য এই উত্তরটা খুব একটা পছন্দ হয়নাই। কাজেই তিনি বললেন সম্পূর্ণ বিপরীত কথা-আমরা যা অনুভব করি, যা কিছু আমরা বাস্তবে দেখতে পাই-তার সবকিছুই চিরন্তন কোন একটা আদর্শের একটা প্রতিরূপ। সেখান থেকে মানুষের ধারণা হলো যে চিরন্তন কিছু সত্য রয়েছে-যেগুলো সবার জন্যে, সব সময়ের জন্যে আদর্শ। তবে সময়ের পরিবর্তনের সাথে মানুষ বোঝা শুরু করলো যে বাস্তবতার যেমন পরিবর্তন হয়-

তেমনি দর্শনেরও পরিবর্তন হয়। কাজেই এই পরিবর্তনকে মাথায় রেখে জার্মান দার্শনিক হেগেল সাহেব বললেন যে-না সব সময়ের জন্যে চিরন্তন কোন সত্য নেই-বরং সত্য উদ্ভুত হবে একটি বিশেষ সময়ের একটি বিশেষ বাস্তবতার উপর নির্ভর করে।আরেক জার্মান কার্ল মার্ক্স আবার তার ঝাকড়া দাড়ির বাবরি দুলিয়ে ঘোষণা করে বসে থাকলেন যে একটা সময়ের সত্যও সবার জন্যে একক সত্য নয়-বরং একেকটা শ্রেণীর জন্যে, একেকটা গোষ্ঠীর জন্যে একেকটা সত্য আলাদা আলাদা। একজন ধনীর কাছে বর্ষা বিলাসের উপলক্ষ্য আর দরিদ্রের কাছে বর্ষা ভীতিসঞ্চারি-কিন্তু দুইটিই কিন্তু সমানভাবে সত্য। তবে সবচেয়ে ভয়ংকর সত্য বলে গেলেন ঝোঁপ-মার্কা গোঁফের মালিক ফ্রেডরিখ নিতচে। তিনি বললেন যে একটি গোষ্ঠীর কাছে সত্যি বলে কিছু নেই-সত্য নিদারুণ ব্যক্তিগত। আমার কাছে যা কিছু সত্যি তা আর কারো কাছে সত্যি হবার সম্ভাবনা খুবই কম কেননা আর কেউ এক্কেবারে আমার মতন একই অভিজ্ঞতা নিয়ে বড় হয়নি। অভিজ্ঞতা যদি আলাদা হয়-সত্যও হবে আলাদা। কাজেই সত্যি বলে কিছু নেই-বরং সবটুকুই ব্যখ্যানির্ভর। There are no facts, only interpretations. 
ঠিক এই কারণেই আমাদের প্রত্যেকের গবেষণা করা প্রয়োজন। সত্যিমিথ্যা সত্যিসত্যি যেখানেই যাক-আমাদের বর্তমানের যুগ নিতচীয় সন্দেহ আর স্বকীয়তার যুগ। প্লেটোর আমলে সবাই একক সত্যে বিশ্বাস করতো-কাজেই একদল পেশাদার দার্শনিক একক সত্য ঘোষণা করে বসে থাকলেই চলতো। হেগেলের সময়ে একদল পেশাদার বুদ্ধিজীবি সেই সময়ের সত্য ঘোষণা করে দিলেই চলতো আর মার্ক্সের সময়ে একদল পেশাদার বিপ্লবী তার শ্রেণীর জন্যে সত্য ঘোষণা করে দিলে চলতো। কিন্তু আমরা এমন এক অদ্ভুত সময়ে জন্মেছি যখন কিনা কেউ কারো সত্যে বিশ্বাস করতে পারছে না। সারা পৃথিবীর মানুষের মাঝে এক ধরণের অবিশ্বাস কাজ করছে আর এই অবিশ্বাস এসেছে আমার অস্থির আধুনিকতার ঘাড় ডিঙ্গিয়ে উপস্থিত হওয়া উত্তরাধুনিক যুগের হাত ধরে। এই অবিশ্বাসের যুগে আমাদের মুক্তির একমাত্র পথ হলো নিজের সত্যের সংজ্ঞা, নিজের মুক্তির সংজ্ঞা নিজের খুজে নেয়া।
আমরা এখন আর পুরোনো আমলের ঋষি-মনীষিদের কথামতন চলতে পারছিনা কারণ আমরা জানি রবীন্দ্রণাথ কোনদিন সেলফি তোলেননি-কাজেই তিনি জানেননা চেক ইনের জগতে ভালোবাসা কারে কয়। আমরা এখন সংবাদপত্রের হেডলাইন আর টক শোর বুদ্ধিজীবিদের মিষ্টি কথায় ভুলতে পারছিনা কারণ আমরা জানি যারা সাংবাদিক আর বুদ্ধিজীবিদের জীবিকা যারা যোগায় তারা সংবাদিকের সংবাদের আর বুদ্ধিজীবিদের বুদ্ধির লাগামও ধরে রাখে আর আমরা এখন বিপ্লবী জননেতাদের ভাষণে কাঁচকলা দেখাচ্ছি কেননা বারংবার নেতাদের তর্জনী আমাদের বিপদের সময়ে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে। অর্থাৎ আমাদের বেখাপ্পা অস্তিত্ব আমাদের আছড়ে ফেলেছে একটা ভয়ংকর সন্দেহ আর স্বকীয়তার যুগে-যেখানে আমাদের সত্য আমাদের নিজেদেরই খুঁজে নিতে হবে। শত শত অচল বাণী চিরন্তনী, ভুয়া সংবাদ আর মিথ্যে প্রতিশ্রুতির সাগর পেরিয়ে আমাদের নিজেদের গবেষণা নিজেদেরই করে নিতে হবে-একান্ত স্বকীয় সত্যটা নিজের করে নিতে হবে কেননা অন্যথায় আর কারো সত্য আমাদের গলায় ঠুসে দেয়া হবে।
তবে দর্শনগত দিক বাদেও গবেষণার একটি খুব বাস্তব ব্যবহারিক প্রয়োজনও রয়েছে-আর সেটা হলো ছাত্র হিসেবে বা একজন একাডেমিক হিসেবে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দেয়া। আমাদের মাঝে অনেকে রয়েছেন যারা উচ্চশিক্ষার জন্যে পরে দেশের বাইরের বিভিন্ন খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানে গবেষণার জন্যে যেতে চান। আর সেই উদ্দেশ্য পূরণের জন্যে গবেষণাপত্র একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। অনেকে মনে করেন যে বিশ্ববিখ্যাত প্রতিষ্ঠানগুলোতে শুধুমাত্র পরীক্ষার নম্বর দিয়ে বা বেশি বেশি সিজিপিএ দিয়ে চান্স পাওয়া যায়-কিন্তু ব্যাপারটি খুব একটা সত্যি না, কারণ ভর্তির ব্যাপারটি অধিকাংশ এডমিশন অফিস এই ক্ষুদ্র বিষয়গুলো দেখে পার করে দিলেও, ফান্ডিং না পেলে কিন্তু ভর্তির সুযোগ পেয়েও খুব একটা লাভ হবেনা কেনোনা পশ্চিমা বিশ্বে শিক্ষার খরচ ভয়াবহ রকমের বেশি। ফান্ডিং-অর্থাৎ পড়াশুনার আর অপরাপর দিনাতিপাতের খরচ আসবে প্রফেসরদের কাছ থেকে টিচিং এসিস্ট্যান্ট বা রিসার্চ এসিস্ট্যান্টের চাকরির বেতন হিসেবে।টিচিং এসিস্ট্যান্ট হতে চাইলে নিজের বিষয়ে পান্ডিত্য প্রদর্শনের সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে গবেষণাপত্র। আর রিসার্চ এসিস্ট্যান্ট হতে চাইলে তো প্রফেসর যে বিষয়ে কাজ করছে, সেই বিষয়ের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ বিষয়ে গবেষণাপত্র থাকাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। 
কাজেই অন্ততপক্ষে স্নাতক পর্যায়ের সকল ছাত্রছাত্রীকে গবেষণাপত্র নিয়ে ঘাটাঘাটি করা শিখতে হবে। আমেরিকায় সাধারণত অষ্টম শ্রেণির থেকে গবেষণাপত্র লেখার বিষয়টা শেখানো হয় এবং অনেক ক্ষেত্রে স্নাতক পর্যায়ে পড়াশুনা শুরু করবার আগেই ছেলেমেয়েরা একটা দুইটা গবেষণাপত্র লিখে ফেলে, যেটা তাদের কাংখিত প্রতিষ্ঠানে সুযোগ পেতে প্রচন্ড সাহায্য করে। তার মানে এই না যে ক্লাস নাইন টেনের বাচ্চারা বিরাট বিরাট আবিস্কার করে বসে থাকে, তার মানে এই যে নাইন টেনের বাচ্চারা অন্যদের আবিস্কারের পদ্ধতি নিজেরা পড়ে বুঝতে পারে। এটি একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা-অন্যের গবেষণা পড়ে বুঝবার শিক্ষা। আমার এই শিক্ষাটি ছিলোনা বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষে আমাকে দারুণ হেনস্থা হতে হয়েছিলো। তারপর থেকে ঠেকে ঠেকে এই বিষয়গুলো শিখতে আমার প্রায় দেড় বছর লেগেছে কেনোনা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সাধারণত সরাসরি খুব মৌলিক গবেষণার কৌশলগুলো, (সাইটেশন, স্টাইল ইত্যাদি) আর সেরকমভাবে শেখানো হয়না কারণ সবাই ধরেই নেয় যে এই ব্যাপারগুলো ছাত্ররা এর মধ্যেই জানে। এমনকি ইংরেজি ক্লাসেও এই মৌলিক বিষয়গুলো হালকার উপর ঝাপসা পড়িয়ে এরচেয়ে জটিল বিষয়গুলোতে চলে যায়। কাজেই আমরা যারা স্কুলে গবেষণার ব্যাপারটা শিখিনাই, তারা বড্ড বিপদে পড়ে যাই।
যেহেতু আমরা ছোট বয়েসে গবেষণার বিষয়টা শিখিনাই-সেহেতু আমাদের মাথায় ঢুকে যায় যে গবেষণা নিশ্চয়ই প্রচন্ড বড় মানুষের কাজ। নিশ্চয়ই গবেষণা করতে গেলে বিরাট বিরাট ইউনিভার্সিটি থেকে ভারী ভারী ডিগ্রি থাকা লাগে, সিজিপিএ ফোর থাকা লাগে, কাঁচাপাকা চুলদাড়ি থাকা লাগে আর ডিমের বদলে ঘড়ি সিদ্ধ করে ফেলার মতন ভুলোমন থাকা লাগে! তবে ব্যাপারটা কিন্তু ঠিক সেরকম না। গবেষণা কিন্তু আমরা সবাই সবসময়ই করছি।
আপনি যদি কখনও এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যান, তাহলেই আপনি গবেষণা করেছেন যে ঠিক কোন উপায়ে গেলে সবচেয়ে ভালো হবে। ধরা যাক আপনি রিকশা করে উত্তরা ছয় নাম্বার সেক্টর থেকে এয়ারপোর্ট স্টেশন পর্যন্ত যাবেন। আপনি চিন্তা করে বের করলেন যে রিকশায় গেলে সবচেয়ে ভালো হবে কারণ জায়গাটা কাছেপিঠেই। এইযে আপনি বাস বা সিএনজি না নিয়ে রিকশা নিলেন-এইটাও কিন্তু একটা গবেষণা। আপনার মাথায় একটা থিওরি (theory) বা সাধারণ সম্পর্কের ধারণা রয়েছে যে কম দূরত্বের জায়গা পাড়ি দিতে রিকশা সবচেয়ে ভালো কারণ সিএনজিতে খরচ বেশি আর বাস সবজায়গায় থামে না।এই যে আপনি একটা সাধারণ ধারণা থেকে আপনার বিশেষ ক্ষেত্রে একটি সিদ্ধান্ত নিলেন-এইটাকে বলা হয় ডিডাকটিভ রিজনিং(deductive reasoning).
এবার ধরেন আপনি এয়ারপোর্ট পর্যন্ত পৌছাতে পৌছাতে দেখলেন যে রাস্তায় প্রচুর জ্যাম, কারণ আপনি যে সময়ে বের হয়েছেন,সেই সময় উত্তরার কলেজগুলো ছুটি হয় কাজেই সেক্টরের ভেতরের রাস্তায় জ্যাম লেগে যায়। আবার আপনি এয়ারপোর্টে নেমে দেখলেন যে একদম স্টেশনের সামনেই বাস থামে যেই বাসের ভাড়া মাত্র পাচ টাকা আর সময় লাগে পাচ মিনিট। অথচ আপনি গর্দভের মতন পচিশ মিনিট ধরে তিরিশ টাকা খরচ করে রিকশায় এসে এয়ারপোর্ট পৌঁছেছেন।
এই যে ধরাটা খেয়ে আপনার শিক্ষা হলো, এইটা থেকে আপনি একটা হাইপোথিসিস(hypothesis) দাড়া করালেন যে স্কুল কলেজ ছুটির সময়ে রিকশা করে এয়ারপোর্ট আসলে বাসের চেয়ে বেশি সময় আর বেশি টাকা খরচ হয়। এইযে আপনি একবার রিকশাভ্রমণের অভিজ্ঞতা দিয়ে একেবারে হামেশা একই সময়ে রিকশাভ্রমণ নিয়ে একটা সম্পর্ক দাড়া করিয়ে ফেললেন-এইটাকে বলে ইনডাকটিভ রিজনিং (inductive reasoning). আর এইযে আপনি বাসের চেয়ে রিকশা ভালো থিওরির একটা ব্যতিক্রম বের করে নতুন একটা হাইপোথিসিস বের করে বসে থাকলেন-এইটাই কিন্তু রিসার্চ। শুধু আপনি আমি গরীব বলে রিকশাযাত্রা নিয়ে রিসার্চ করে ভাত পাইনা। বাপের পয়সা থাকতো-তাইলে এতোদিনে আপনি আমিও বিরাট বিরাট রিসার্চের হয়ে ভাবসাব নিয়ে ঘুরতাম। 
আসলে ব্যাপারটা পুরোপুরি সত্যি না। আমাদের এই প্রতিদিনকার রিসার্চ আমাদের নিজেদের জন্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ হলেও সেগুলো রিসার্চ জার্নালে ছাপা হয়না কারণ এই সমস্যাগুলো আমাদের খুব ব্যক্তিগত সমস্যা-সামাজিক সমস্যা না। যদি আমি ব্যক্তিগত যাতায়াতের সমস্যা নিয়ে রিসার্চ না করে এমন একটা সমস্যা নিয়ে রিসার্চ করতাম যেটাতে বাকি দশজন প্রভাবিত হয়-তাহলে বাকি দশজন আমাকে পাত্তা দেয়ার কিছুটা সম্ভাবনা ছিলো।
তবে এটুকু নিশ্চিত যে মৌলিক গবেষণা করতে বিরাট কোন ডিগ্রীধারী হতে হয়না। আমরা সবাই প্রত্যেকদিনের জীবনে ছোট ছোট গবেষণা করে যাচ্ছি এবং আমরা প্রত্যেকে এর থেকে বড় বড় গবেষনা করতেও সক্ষম। গবেষণা করবার জন্যে কোন নির্দিষ্ট শ্রেণী, বয়স বা শিক্ষাগত যোগ্যতা লাগেনা বরং লাগে কেবল ধৈর্য আর একটা ইন্টারনেট কানেকশন। এই দুইটা জিনিস থাকলে যে কেউ পৃথিবীর যেকোন প্রান্তে বসে গবেষণা করতে পারে। ব্যক্তিগত গবেষণা করে নিজের জন্যে সত্য আর নিজের জন্যে সুবিধা বের করে আনতে পারে-আর আরেকটু ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর শখ থাকলে সামাজিক সমস্যারও সমাধান করতে পারে। যদি কেউ যথোপযুক্ত বড়সড় সমস্যার সমাধান করতে পারে-তখন সে চাইলে সেটিকে একটা গবেষণাপত্র (research paper) আকারে লিখে ফেলতে পারে আর বিশ্বের যেকোন ওপেন রিসার্চ জার্নালে পাঠিয়ে দিতে পারে (এইসব জার্নালের ইমেইল এড্রেস গুগল করলেই পাওয়া যায়)। তবে ঝামেলার ব্যাপার হলো যে কেউ একজন আমাদের বুঝতে শিখিয়েছে যে আমাদের দ্বারা রিসার্চ করা হবেনা অথবা রিসার্চ করতে গেলেই কিছু বাঁধাধরা শুষ্ক বিষয় নিয়ে করতে হবে-যেগুলো আমাদের খুব একটা ভালো লাগেনা।
আসলে গবেষণা করতে চাইলে যেকোন বিষয়েই করা যায়। একজন গবেষকের প্রথম প্রশ্ন হওয়া উচিত নয় যে আমি কোন বিষয়ে গবেষণা করতে পারবো-বরং তার প্রথম প্রশ্ন হওয়া উচিত আমি কি নিয়ে গবেষণা করতে চাই। কি নিয়ে গবেষণা করতে চাই-এটা বের করা অনেকের জন্যে বেশ কঠিন একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় বলে আমার প্রফেসর ডক্টর চার্লস ভারহারেন একটা কোয়েশ্চেনিয়র দাড়া করিয়েছেন। তার অনুমতিক্রমে তার সিলেবাস থেকে এই অংশটি চুরি করে আমি অনুবাদ করে দিলাম। এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিলে আপনি হয়তো আপনার পছন্দের গবেষণার প্রশ্ন(research question) খুঁজে পেয়ে যাবেন।
১) আপনার জীবনে সবচেয়ে বড় সমস্যা কি? এই সমস্যাটি ভালো সমস্যা বা খারাপ সমস্যা হতে পারে। ভালো সমস্যা হলো এমন একটা সমস্যা যেটা আপনাকে ভাবায়, চিন্তায় ফেলে দেয়-আর খারাপ সমস্যা হলো যেটা আপনার জীবনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।
২) আপনার শহর, দেশ, জাতি বা পৃথিবীর জন্যে সবচেয়ে বড়ো সমস্যা কোনটা?
৩) আপনার পড়াশুনার (স্নাতকের) বিষয়ের সাথে আপনার পছন্দের সমস্যার সম্পর্ক কি? আপনার বিষয় কি) আপনার সমস্যা সমাধান করতে সাহায্য করে? যদি আপনি এখনও বিষয় নির্বাচন না করে থাকেন-তাহলে আপনার সমস্যা কি আপনাকে বিষয় নির্বাচন করতে সাহায্য করবে?
৪) এই সমস্যাটার সমাধান করা আপনার ভবিষ্যত জীবনে কেমন করে কাজে দেবে?
৫) এই মুহুর্তে আপনি কোন সমস্যা নিয়ে কাজ করতে চান?
৬) আপনার সমস্যা সমাধানের জন্যে কি আপনার কোন মৌলিকভাবে স্বকীয় উপায় রয়েছে?
৭) আপনার সমস্যা সমাধানের জন্যে আর কোন মৌলিকভাবে স্বকীয় উপায় কি আপনার জানা রয়েছে?
৮) কোন সমাধানটি সবচেয়ে ভালো বলে মনে হয়? কোন যুক্তিতে?
৯) কোন স্নাতকের বিষয়ে আপনার সমস্যাটির সমাধানের জন্যে সবচেয়ে ভালো জ্ঞান পাওয়া যাবে?
১০) আপনার বিষয়ের কোন পূর্বতন গবেষক এই সমস্যার মৌলক ভিন্নধারার সমাধান বের করেছেন?
গবেষনার প্রশ্ন খুঁজে বের করবার পরে বের করে নিতে হবে গবেষণার ধরণ। প্রধাণত গবেষণা দুই ধরণের-প্রাথমিক গবেষনা, আর মাধ্যমিক গবেষণা। প্রাথমিক গবেষণা (primary research) হলো এমন গবেষণা যেখানে উপাত্ত সংগ্রহ আর পরিসংখ্যান সংক্রান্ত বিশ্লেষণ থেকে শুরু করে অনুসিদ্ধান্তে আসা পর্যন্ত সব  দায়িত্ব গবেষকের নিজের আর মাধ্যমিক গবেষণা (secondary research) হলো অন্য কারোর প্রাথমিক গবেষণার উপর গড়ে তোলা নিজের বিশ্লেষণ। অর্থাৎ উপাত্ত সংশ্লেষণের কাজটুকু আর কেউ করবে-কিন্তু তার কাজ কাজে লাগিয়ে আমি আমার মৌলিক অনুসিদ্ধান্তে উপনীত হবো। নিচের অংশটিতে প্রাথমিক আর মাধ্যমিক-দুই ধরণের গবেষণা পদ্ধতিরই বিবরণ দেয়া হলো। এই বইয়ের পাঠকদের জন্য আর আমার নিজের জন্যেও মাধ্যমিক গবেষণা বেশি সুবিধাজনক-কাজেই কেউ চাইলে প্রাথমিক গবেষণার অংশটুকু টপকে মাধ্যমিক গবেষণার অংশটুকুতেও চলে যেতে পারেন

Comments

Popular posts from this blog

Link3 FTP Server

যে কারনে রাত জেগে কাজ করা বেশি প্রোডাক্টিভ!