শিক্ষা কি মানুষের মনুষত্ব গড়তে সক্ষম?
বাসে উঠে একটা খালি সীট পেলাম। জানালার পাশে আমি বসলাম, আর পাশের সীটটা খালি। একটু পরেই দেখি আমার বয়সী একটা সুন্দরী মেয়ে উঠলো । বোরকা পড়া ,মাথায় হিজাব দেয়া । মেয়েটাকে এক নজর দেখলেই বোঝা যায় খুবই ভদ্র ও অবস্থা সম্পন্ন ঘরের মেয়ে । এদিক ওদিক সিট খুজে শেষে আমার পাশে এসে বসলো । হাতে একটা মোবাইল । দেখে বোঝা যায় অনেক দামী একটা মোবাইল । কিছুদূর যাবার পর বাস আবার জ্যামে পড়লো । মেয়েটা বলে উঠলো, অসহ্য জ্যাম ! আমিও হুম বলে সম্মতি জানালাম । এরপর টুকটাক কথা হতে লাগলো । বাসও চলতে শুরু করলো। কথায় কথায় জানলাম, ইংরেজিতে অনার্স করছে । খুবই ফ্রী ভাবে কথা বলছিলাম আমরা । . এয়ারপোর্টের ওখানে গিয়ে আবারও জ্যামে পড়লো বাস। বিরক্তিকর জ্যাম! জ্যামের মধ্যেই বাসে ওঠলো সাদা শার্ট পড়া কালো চেহারার মধ্যে বয়সী একটা লোক । অনেক দিনের পুরনো বোধহয় শার্ট টা । ময়লা হয়ে আছে। তার হাতে অনেক গুলো নামাজ শিক্ষা বই । কাধে কালো রঙের একটা ব্যাগ । লোকটা নামাজ শিক্ষা বই বিক্রি করছে । লোকটা অনেক্ষণ যাবত , বইতে কি কি গুরুত্বপূর্ণ দোয়া , সূরা, মাসলা ইত্যাদি আছে তা বর্ননা করলো । কিন্তু বাসের কেউ একটা বইও কিনলো না । . আমার খুব খারাপ লাগলো । ইচ্ছে করছিল লোকটাকে কিছু টাকা দিয়ে সাহায্য করি । কিন্তু লোকটাকে টাকা দিতে চাইলে যদি কিছু মনে করে! তাই দিলাম না । একটা জিনিষ লক্ষ্য করলাম লোকটা বাসে ওঠার পর থেকে মেয়েটি আমার সাথে একটা কথাও বলেনি । মাথা নিচু করে মোবাইল টিপছে । বাড়িতে নামাজ শিক্ষা বই থাকা সত্বেও শুধু মাত্র লোকটিকে সাহায্য করার ইচ্ছায় বিশ টাকা দিয়ে দুইটা বই কিনলাম । লোকটিকে পঞ্চাশ টাকার নোট দিলে সে ত্রিশ টাকা ফেরত দিল ।টাকা ফেরত দেবার পরেও দেখি সে পকেট থেকে আরও টাকা বের করছে । একটা একশ টাকার নোট আর কয়েকটা দশ টাকার নোট ৷ . আমার দিকে এগিয়ে ধরলো ! আমি তো অবাক ! আমাকে টাকা দেবেন কেন উনি ! আমার ভুল ভাঙলো তার ডাক শুনে । তিনি আমাকে না মেয়েটিকে টাকা দিচ্ছেন ! তিনি বললেন , ‘সোমা টাকাটা রাখো । কিছু কিনে খেয়ে নিও । তোমার মা বললো, তুমি সকালে না খেয়েই ভার্সিটিতে চলে আসছো‘ । . মেয়েটি লজ্জায় মরে যাচ্ছিল । সে অত্যন্ত রেগে লোকটার দিকে তাকালো । বললো , লাগবে না । লোকটি জোর করে টাকাটা তার হাতে দিয়ে বাস থেকে নেমেগেল । মেয়েটার দিকে তাকানো যাচ্ছিল না! রেগে টং হয়ে আছে ! আমি কৌতুহল সামলাতে পারলাম না । জিজ্ঞেস করলাম ,যে আপনাকে টাকা দিল উনি কে? মেয়েটা বললো , আমাদের বাড়ির পাশে থাকে ! আমি বললাম, কিছু মনে করবেন না । একটা কথা বলি, উনি কি আপনার বাবা? . মেয়েটি রেগে তাকালো আমার দিকে! জবাব দিলো না ! এমন ভাব করলো যেন আমি মহা অপরাধ করে ফেলেছি ! আমি বুঝতে পারলাম তার রাগের কারন ! তার বাবা একজন ভ্রাম্যমাণ হকার ।
বাসে বাসে ঘুরে বই বিক্রি করে। আর সে দামী পোশাক পড়ে ভার্সিটিতে যায় ! সে একজন শিক্ষিত মানুষ ! এজন্য সে বাবার পরিচয় দিতে লজ্জা পায়! এই ময়লা শার্ট পড়া লোকটাকে বাবা বলে স্বীকার করাটাকে সে ঘৃনার চোখে দেখে! সে চায় না দুনিয়ার কেউ জানুক এই হকার তার বাবা ! . কত বড় বিবেক সম্পন্ন মানুষ সে ! যে লোকটা রাত দিন পরিশ্রম করে বাসে বাসে মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বই বিক্রি করে মেয়েটাকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলছে । তাকে লেখা পড়া শেখাচ্ছে । নিজে কয়েক বছরের পুরনো একটা শার্ট পড়ে অথচ মেয়েটিকে দামী পোশাক, ব্যাগ, দামী মোবাইল কিনে দিয়ে তার সমস্ত চাওয়া পূরন করেছেন । সেই মানুষটাকে বাবা বলে পরিচয় দিতে লজ্জা করছে মেয়েটির ! কত বড় নির্লজ্জ ! যে মানুষটা তাকে লালন পালন করে এত বড় করলো , যারটা খেয়ে বেচে আছে তাকে বাবা বলে পরিচয় দিতে সমস্যা ! . মেয়েটি হয়তো শিক্ষিত হচ্ছে , কিন্তু তার ভেতরে বিবেক ও মনুষ্যত্ব তৈরি হয়নি । হকার লোকটির প্রতি শ্রদ্ধায় মনটা ভরে উঠলো । লোকটা হাজার কষ্টের মাঝেও পরম মমতায় নিজের মেয়েটিকে উচ্চশিক্ষিত করে তুলছেন । আদর্শ বাবা মনে হয় একেই বলে! অন্য কেউ হলে হয়তো অনেক আগেই মেয়েটিকে কোন শ্রমিকের সাথে বিয়ে দিয়ে দিত । সেটাই বোধহয় ভাল হত! তাহলে তখন হয়তো মেয়েটি বাবার পরিচয় অস্বীকার করতো না! যেই শিক্ষা আমারদের মধ্যে বিবেক ও মনুষ্বত্ব তৈরী করেনা, কি লাভ সেই শিক্ষা গ্রহনে করে? শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় নয় আমরা আমাদের সন্তানদের নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলব ইনশা আল্লাহ।
Comments
Post a Comment